গােবিন্দগােপাল মুখােপাধ্যায়ের গীতার কথা অমৃতকথা

শােনাচ্ছেন, তুমি সর্বভূতের মধ্যে আমাকে দেখাে। ভগবানের জন্য শুধু দুফোটা চোখের জল ফেললেই ভক্ত হয় না। যথার্থ ভক্ত হবে | সে-ই, যে সর্বভূতের মধ্যে আমাকে দেখতে পাবে। সমস্ত ভূতের মধ্যে
আমাকে দেখতে পাওয়ার ফলেই আর কখনাে আমি তার দৃষ্টির অগােচরে থাকি না। সব সময়েই সে আমার নয়নে নয়নে থাকে, আমিও তার নয়নে। নয়নে থাকি। আমিও তার দৃষ্টির বহির্ভূত হই না, এবং সে-ও আমার দৃষ্টির বহির্ভূত হয় না। এইরূপে যােগের যখন ক্রমশ ক্রমশ গভীরতা হবে, তখন সেই গভীরতার ফলে তার আর কোনাে সাধনের প্রয়ােজন থাকে না, কর্মের প্রয়ােজন থাকে না, সে যােগারূঢ় হয় এবং ক্রমশ যুক্ততর ও যুক্ততম অবস্থা লাভ করে। প্রথম, তাতে মনকে নিয়ােজন, শেষে তাতে নিমগন।। | দুটি মুখ্য সাধনের কথা এখানে ভগবান শিখিয়েছেন। যােগশাস্ত্রেও সেই। একই কথা বলেছেন, অভ্যাস ও বৈরাগ্য। এই যে চঞ্চল মন ছুটে ছুটে বেড়িয়ে যাচ্ছে, তাকে কেবল গুটিয়ে আনা, তাকে কেবল কেন্দ্রের সঙ্গে যােগ করিয়ে দেওয়া, আবার সেই কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনা—এই যে প্রয়াস, এতে তাে হয়রান হয়ে যেতে হবে। কেমন করে তা সম্ভব? অর্জুন বলছেন, এ যে বড়াে চঞ্চল, কৃষ্ণ, তাকে কেমন করে আমি নিগ্রহ করব? কেমন করে বশীভূত করব? ভগবান স্বীকার করেছেন যে হ্যাঁ, মন সত্যই বড়াে চঞ্চল, মনকে বশ করা বড়ােই কঠিন, কিন্তু দুটি উপায় আছে।।
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে৷৷ এই দুটি উপায়ের দ্বারা মনকে বশীভূত করা যায়। একটির নাম অভ্যাস, আর একটির নাম বৈরাগ্য। একটি positive method, আর একটি negative method। অভ্যাস হল ক্রমশ ক্রমশ তাঁর দিকে এগিয়ে যাওয়া, আর বৈরাগ্য হল, যে বিষয়ের দিকে মন ছুটছে সেদিকে বাঁধ দেওয়া, সেদিক থেকে মনকে ফিরিয়ে আনা। পাতঞ্জল যােগদর্শনের একটি সূত্রেও শুনিয়েছেন ‘অভ্যাসবৈরাগ্যাভাং তন্নিরােধঃ-(সমাধিপাদ)। চিত্তের নিরােধ হয় কিসের দ্বারা? অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা। |
একটি অনুপম উপমার দ্বারা ব্যাসভ্যায্যে শুনিয়েছেনঃ “চিত্তনদী নাম উভয়তাে বাহিনী’ দু’দিকে বয়ে যায় চিত্তরূপ নদী। বহতী কল্যাণায়, বহতি পাপায় চ’, একটি কল্যাণের ধারা, আর একটি পাপের ধারা, অকল্যাণের ধারা, অমঙ্গলের ধারা। বৈরাগ্যের দ্বারা কী করতে হয়? ‘বিষয়শ্রোতঃ খিলীক্ৰিয়তে,' বিষয়ের স্রোতকে বন্ধ করতে হয়, অবরুদ্ধ করতে হয়, বাঁধ। দিতে হয়। এইজন্য এটা negative method। আর ‘বিবেকদর্শনাভ্যাসেন’ কী করতে হয়? বিবেকস্রোত উদঘাটতে’, ওদিকের স্রোতকে উদঘাটন করতে হবে। ক্ষেতে যেমন আল কেটে কেটে রাস্তা করে দিতে হয়, তবে সেদিকে জল প্রধাবিত হয়, তেমনি কেটে কেটে আমাকে সেদিকের পথ তৈরী করতে হবে, সেদিকে চিত্তের প্রবণতা বা গতি ফেরাতে হবে। চিত্তের যে বহির্মুখ গতি, তাকে অন্তর্মুখ গতি করে নিতে হবে। এই double method, দুদিকে যুগপৎ প্রয়ােগ করতে হবে। সেইজন্য ভগবান ‘চ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন— ‘অভ্যাসন তু’ আর ‘বৈরাগ্যেণ চ’। এইজন্য যৌগপদ্য, দুটিকে একসঙ্গে, বাঁধ দেওয়া এবং আল কাটা যুগপৎ করে চলতে হবে। এই করতে করতে ক্রমশ যখন আমরা এগিয়ে যাব তখন কোথায় গিয়ে পৌছব? গােবিন্দগােপাল মুখােপাধ্যায়ের গীতার কথা