রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ব্ৰহ্মমন্ত্র’ অমৃতকথা

ব্ৰহ্মমন্ত্র:সমস্ত আপেক্ষিক সত্যের অতীত সেই পরম সত্যকে কেবলমাত্র জ্ঞানের দ্বারা বিচার করা সেও সামান্য কথা নহে, শুদ্ধ যদি সেই জ্ঞানের অধিকারী হইতেন তবে তাহাতেও সেই স্বল্লাশী বিরলবসন সরলপ্রকৃতি বনবাসী প্রাচীন আর্য ঋষিদের বৃদ্ধিশক্তির মহৎ উৎকর্য প্রকাশ পাইত। কিন্তু উপনিষদের এই ব্রহ্মজ্ঞান কেবলমাত্র বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারা সাধন নহে-সকল সত্যকে অতিক্রম করিয়া ঋষি যাঁহাকে একমাত্র তদেতৎ সত্যং বলিয়াছেন, প্রাচীন ব্রহ্মজ্ঞদের পক্ষে তিনি কেবল জ্ঞানলভ্য একটি দার্শনিক তত্ত্বমাত্র ছিলেন না। একাগ্রচিত্ত ব্যাধের ধনু হইতে শর যেরূপ প্রবলবেগে প্রত্যক্ষ সন্ধানে লক্ষ্যের দিকে ধাবমান হয়, ব্রহ্মর্ষিদের আত্মা সেই পরমসত্যের মধ্যে প্রবেশ করিয়া তন্ময় হইবার জন্য সেইরূপ আবেগের সহিত ধাবিত হইত। কৈবলমাত্র সত্যনিরূপণ নহে, সেই সত্যের মধ্যে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ তাঁহাদের লক্ষ্য ছিল। কারণ, সেই সত্য কেবলমাত্র তাঁহাদের লক্ষ্য ছিল। কারণ, সেই সত্য কেবলমাত্র সত্য নহে, তাহা অমৃত। তাহা কেবল আমাদের জ্ঞানের ক্ষেত্র অধিকার করিয়া নাই, তাহাকে আশ্রয় করিয়াই আমাদের আত্মার অমরত্ব। সেই জন্য সেই অমৃতপুরুষ ছাড়িয়া আমাদের আত্মার অন্য গতি নাই, ঋষিরা ইহা প্রত্যক্ষ জানিয়াছেন এবং বলিয়াছেন—
| স যঃ অন্যম আত্মনঃ প্রিয়ং ব্রুবাণং ব্রুয়াৎ।
অর্থাৎ, যিনি পরমাত্মা ব্যতীত অন্যকে আপনার প্রিয় করিয়া বলেনপ্রিয়ং রােৎস্যতীতি—তাঁহার প্রিয় বিনাশ পাইবে। আমাদের জ্ঞানের পক্ষে যে সত্য সকল সত্যের শ্রেষ্ঠ আমাদের আত্মার পক্ষে তাহাই সকল প্রিয়ের প্রিয়তম তদেতৎ প্রেয়ঃ পুত্ৰাৎ, প্রেয়াে বিত্তাৎ, প্রেয়ােহন্যস্মাৎ সর্বসম্মৎ অন্তরতরং যদয়মাত্মা। এই-যে সর্বাপেক্ষা অন্তরতর পরমাত্মা ইনি আমাদের পুত্র হইতে প্রিয়, বিত্ত হইতে প্রিয়, অন্য সকল হইতে প্রিয়। তিনি শুষ্ক জ্ঞানমাত্র নহেন, তিনি আমাদের আত্মার প্রিয়তম। আধুনিক হিন্দুসম্প্রদায়ের মধ্যে যাঁহারা বলেন ব্রহ্মকে আশ্রয় করিয়া কোনাে ধর্ম সংস্থাপন হইতে পারে না, তাহা কেবল তত্ত্বজ্ঞানীদের অবলম্বনীয়, তাঁহারা উক্ত ঋষিবাক্য স্মরণ করিবেন। ইহা কেবল বাক্যমাত্র নহে—প্রীতিরসকে নিবিড় নিগূঢ় রূপে আস্বাদন করিতে না পারিলে এমন উদার উন্মুক্ত ভাবে এমন সরল সৰল কণ্ঠে প্রিয়ের প্রিয়ত্ব ঘােষণা করা যায় না। তদেতৎ প্রেয়ঃ পুত্ৰাৎ প্ৰেয়াে বিত্তাৎ প্রেমােহন্যস্মাৎ সম্মাৎ অন্তরতরং যদয়মাত্মাব্রহ্মর্ষি এই কথা কোনাে ব্যক্তি বিশেষে বদ্ধ করিয়া বলিতেছেন না। তিনি বলিতেছেন না, যে, তিনি আমার নিকট আমার পুত্র হইতে প্রিয়, বিত্ত হইতে প্রিয়, অন্য সকল হইতে প্রিয়। তিনি বলিতেছেন আত্মার নিকটে তিনি সর্বাপেক্ষা অন্তরতর-জীবাত্মা মাত্রেরই নিকট তিনি পুত্র হইতে প্রিয়, বিত্ত হইতে প্রিয়, অন্য সকল হইতে প্রিয়– জীবাত্মা যখনই তাঁহাকে যথার্থরূপে উপলব্ধি করে তখনই, বুঝিতে পারে তাঁহা অপেক্ষা প্রিয়তর আর কিছুই নাই। অতএব পরমাত্মাকে যে কেবল জ্ঞানের দ্বারা জানি তদেতৎ সত্যং তাহা নহে, তাঁহাকে হৃদয়ের দ্বারা অনুভব করিব তদমিতং।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ব্ৰহ্মমন্ত্র’